Pages

Thursday, March 31, 2016

ভারত জয় করা বাংলাদেশ

পার্শ্ববর্তী দেশ হলেও ভারতের সাথে বাংলাদেশের খেলাধুলার বিভিন্ন আসর বেশ জমজমাট হয়। এখন তো ক্রিকেট চলে গেছে অন্য উচ্চতায়। যার সংখ্যাটা দিনে দিনে বাড়ছে। এরই মধ্যে ক্রিকেটে ভারতে বাংলাদেশের অনেক ভক্তও হয়ে গেছে। ইস্টবেঙ্গলে খেলে মোনেম মুন্না কলকাতাবাসীর হৃদয় জয় করেন। এরপর আইপিএলে সাকিব। এখন কলকাতাজুড়ে শুধুই মুস্তাফিজের নাম। ইডেন গার্ডেনসে অনুষ্ঠিত ম্যাচে বাংলাদেশ শোচনীয়ভাবে হার মানে নিউজিল্যান্ডের কাছে। 
 
কিন্তু ২২ রানে ৫ উইকেট নিয়ে মুস্তাফিজ কলকাতা জয় করেন। এক ম্যাচ খেলে মুস্তাফিজ এখন কলকাতাবাসীর প্রিয় ক্রিকেটার হয়ে গেলেন। বিশ্বকাপ মিশন শেষ করে বাংলাদেশ এরই মধ্যে দেশে ফিরেছে। অথচ কিউই ম্যাচের পরদিন কলকাতাজুড়ে একটাই আলোচনা ছিল বাংলাদেশের মুস্তাফিজ। সৌরভ গাঙ্গুলী অনেকটা মজা করে বলেন, ভাগ্য ভালো ক্রিকেট ছেড়ে দিয়েছি। তা না হলে মুস্তাফিজের বল মোকাবিলা করতে হিমশিম খেতে হতো। ঢাকায় ভারতের বিপক্ষে এই ছেলে দুর্দান্ত বল করে আলোচনায় উঠে আসে। ও যে আলোচনার পাত্র তা এবার স্বচক্ষেই দেখলাম। পাঁচ আউটের মধ্যে চারটিই বোল্ড। কী অসাধারণ বোলিং। এমন খেলতে পারলে উইকেট শিকারের দিক দিয়ে সবাইকে ছাড়িয়ে যাবে। ওর বল আসলে ব্যাটসম্যানরা বুঝতেই পারে না।
কলকাতায় অনেক ক্রিকেট হয়েছে। অনেক ক্রিকেটার নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু এক ম্যাচ খেলেই মুস্তাফিজকে ঘিরে যে হৈচৈ পড়ে গেছে, তা কারও বেলায় হয়নি। ‘একটা সময় বাংলাদেশের বিপক্ষে ক্রিকেট খেলেছি। কিন্তু এই দলে কারা খেলছেন তা নিয়ে আমার তেমন আগ্রহ থাকত না। কার্ডিফে বাংলাদেশের কাছে হারার পর আশরাফুলকে ভালোভাবে চিনলাম। এরপর সাকিবকে।
এখন আর খেলছি না, তারপরও আমাকে জিজ্ঞাসা করুন বাংলাদেশে কারা খেলছেÑ এক নিঃশ্বাসে সবার নাম বলে দিতে পারবো।’ কথাগুলো আর কারো নয়, গোটা ক্রিকেট বিশ্ব তাকে এক নামে চেনে, গতির রাজা অস্ট্রেলিয়ার সাবেক তারকা বোলার ব্রেট লি। একটু দম নিয়ে আবারও শুরু বাংলাদেশ বন্দনা, ‘এক সময়ে বাংলাদেশ জিতলে অঘটন বলা হতো। এখন সময়টা বাংলাদেশেরই বলতে হবে। ওয়ানডে, টেস্ট ও টোয়েন্টি-২০ সব ক্যাটাগরিতে দুর্দান্ত খেলছে বাংলাদেশ। ক্রিকেটে বাংলাদেশ এত এগিয়ে যাবে তা আমি ভাবতেও পারিনি। অস্বীকার করব না, একসময় বাংলাদেশকে নিয়ে আমিও তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছি। সেটা যে কতটা ভুল ছিল তা প্রমাণ পাচ্ছি।’ কারণ হিসেবে কিংবদন্তি এই পেসার যা বললেন তাতে অস্ট্রেলিয়ার বাংলাদেশে না আসবার কারণটাও কি যথেষ্ট নয়? যোগ্য করা কথাগুলো ছিলো, ‘যোগ্য নেতৃত্ব, ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং- সবকিছুতেই বাংলাদেশ এখন অসাধারণ। হয়তো এখনো দেশটি বড় কোনো ট্রফি জিততে পারেনি। কিন্তু আমার বিচারে ক্রিকেটে বর্তমানে সবচেয়ে ব্যালেন্সড দল বাংলাদেশই। তামিম, সৌম্য, মাহমুদউল্লাহ, সাব্বিরের ব্যাটিং, সাকিবের অলরাউন্ড নৈপুণ্য, আল-আমিন, মুস্তাফিজের বোলিংয়ে যেন স্বপ্নের এক দল। এবার টোয়েন্টি-২০ বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের কাছে ম্যাচ হারলেও বাংলাদেশের নৈপুণ্য দেখে অভিভূত হয়েছি। বিগ স্কোর গড়েও স্বস্তিতে ছিল না অস্ট্রেলিয়া। আর ভারতের কাছে হারটা দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কিছুই নয়। ৩ বলে ২ রান এ অবস্থায় বাংলাদেশ ম্যাচ জিতবে শতভাগ ক্রিকেটপ্রেমীই নিশ্চিত ছিলেন। ভুল তো ছিলই, আমি বলব ধোনির দক্ষ ক্যাপ্টেনসি বাংলাদেশকে জিততে দেয়নি। ক্রিকেটে এমন হতেই পারে।
বাংলাদেশ আমার মন জয় করেছে।’ তাপরই নিজের জগত থেকে একটু ঘুরে এসে চোখ রাখলেন বাংরাদেশের পেস বিস্ময় মুস্তাফিজের দিকেই। জানালেন তার অনুভূতি, ‘মুস্তাফিজের বোলিং প্রসঙ্গে বলব, এ মুহূর্তে আমি তাকে বিশ্বের সেরা বোলারই বলবো। পারফরম্যান্সের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারলে, ২০১৯ সালে ওয়ানডে বিশ্বকাপে বাংলাদেশই হবে টপ ফেবারিট দল।’ শুধু ব্রেট লিই কেন মুস্তাফিজের এই কীর্তিতে সাবেক ক্রিকেটাররা মুগ্ধ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে মুস্তাফিজ-বন্দনা। ভিভিএস লক্ষ্মণ যেমন টুইট করেছেন, ‘মুস্তাফিজ প্রতিনিয়ত মুগ্ধ করেই যাচ্ছে। দারুণ নিয়ন্ত্রণ ও বৈচিত্র্য আছে তার। আর কী বলার আছে?’ মুগ্ধ সাবেক লেগস্পিনার অনিল কুম্বলেও, ‘খুবই ভালো লাগছে। বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের একজন তরুণ তার জাদু দেখাচ্ছে।’ আরেক সাবেক ও এখন বিশ্লেষক আকাশ চোপড়াও মুগ্ধ, ‘মুস্তাফিজ আসলেই টোয়েন্টি-২০’র তারা, বিশেষ করে সøথ পিচে। কল্পনা করুন তো, সে, নেহরা ও বুমরা আইপিএলে সানরাইজার্সের হয়ে খেলছে!’ আইপিএলে মুস্তাফিজের দল সানরাইজার্স হায়দরাবাদে আছেন ইংলিশ অলরাউন্ডার লুক রাইট। তিনিও মুগ্ধ মুস্তাফিজে, ‘দুর্দান্ত এক প্রতিভা সে। এমনকি টিভিতেও ওর সেøা বল পড়তে পারা কঠিন!’ আইপিএলের পর মুস্তাফিজের খেলার কথা ইংল্যান্ডের কাউন্টি দল সাসেক্সের হয়ে। সাবেক ইংলিশ ক্রিকেটার মাইকেল ভন সেটি মনে করিয়ে দিলেন, ‘দারুণ একজনকে পেয়েছে সাসেক্স, মুস্তাফিজ আসলে অসাধারণ একজন বোলার।’ এ যখন অর্জনের খাতায় লেখা থাকে তখন উল্টোপিঠটাও দেখে নেয়া যাক। ভারতের বিপক্ষে ৩ বলে ২ রানের সমীকরণ মেলাতে না পারার তীব্র অপরাধবোধে ভুগতে থাকা মুশফিকুর রহিম ও মাহমুদউল্লাহর কাছে অজ্ঞাতনামা এক ক্রিকেটভক্তের রাখা প্রশ্ন এটি। যে প্রশ্ন রাখার আগে-পরে ওই ভক্ত সোনালি স্মৃতির ফ্রেমে বাঁধাই করে রাখার মতো এ দুই ব্যাটসম্যানের একেকটি কীর্তিকেও গেঁথেছেন এক সুতোয়। তাতে দাঁড়িয়ে যাওয়া ভিডিওটি মুশফিকের দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ের ভার অনেকখানি কমিয়েছে নিঃসন্দেহে। না হলে সেটি হাতে আসতে না আসতেই কেন নিজের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে শেয়ার করবেন! সেই সঙ্গে লিখে দেয়া এ কথাটিও নির্ভার মুশফিককে অনেকটাই তুলে ধরতে পেরেছে, ‘এই ভিডিওর নির্মাতাকে ধন্যবাদ। দারুণ অনুপ্রেরণাদায়ী এক ভিডিও এটি।’ যে ভিডিওর নির্মাতা এর আগে তাদের দুজনের ব্যাটেই দেখা দেয়া সাফল্যের বিশাল এক খতিয়ানই তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। ‘রিয়াদ ভাই, মুশফিক ভাই। পর সমাচার এই যে, টেনশন নিয়েন না! কিসের টেনশন? ২ রান নিতে পারেন নাই, তাই? ভাই, আপনারা দুজন মিলে এরকম কয় শো রান করে দিয়েছেন, হিসাব আছে? শুনবেন? আচ্ছা কয়েকটি বলি’, বলে সেই যে শুরু করেছেন লম্বা ফিরিস্তি, তাতে ভক্ত হৃদয়ে তাদের দুজনের ব্যর্থতার চেয়ে সাফল্যের উজ্জ্বল উপস্থিতির বার্তাই পেয়েছেন মুশফিকরা। ভারতের বিপক্ষে জয়ের তীরে এক পা দিয়ে রেখেও জিততে না পারার দায় নিয়ে এক ফেসবুক বার্তার মাধ্যমে ইতিমধ্যেই জাতির কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের টেস্ট অধিনায়ক। কিন্তু সেটিরও প্রয়োজন ছিল না বলেই মনে করেছেন ওই ভক্ত, ‘মুশফিক ভাই, মাফ চাওয়ার কী আছে? বেশি না বলি। একটা শুধু মনে করাই।’ মুশফিকের সেই ‘একটি’ ইনিংস মাত্র ২৫ বলে অপরাজিত ৪৬ রানের। তিনটি করে ছক্কা ও বাউন্ডারিতে সাজানো যে ইনিংসটি শচীন টেন্ডুলকারের শততম আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরির আনন্দকে হারের হতাশায় বিলীন করেছিল ২০১২ সালের এশিয়া কাপে। ভারতের ২৮৯ রান তাড়া করে ৪ বল বাকি থাকতেই ৫ উইকেটে জেতা বাংলাদেশের জয়টি সহজ করার ক্ষেত্রে বিধ্বংসী মুশফিককেও মনে করিয়ে দিয়েছেন ওই ভক্ত। ১২ বলে যখন ১৬ রান দরকার ছিল, তখন ভারতীয় পেসার প্রবীণ কুমারকে টানা দুই বলে চার ও ছক্কা হাঁকিয়ে টার্গেট একদম নাগালের মধ্যে নিয়ে আসেন মুশফিকই। অবশ্য এই সুযোগে ইরফান পাঠানের করা এর আগের ওভারটির কথাও উল্লেখ না করলেই নয়। ১৮ বলে দরকার ছিল ৩৩ রানের আর সেই সময়ে বাঁ-হাতি পেসারকে টানা দুই বলে মারা ছক্কাও টার্গেট সাধ্যের মধ্যে নামিয়ে এনেছিল। এরপর জেতার জন্য ঠোঁট আর চায়ের কাপের যে দূরত্বটা ছিল, সেটি অশোক দিন্দাকে মারা বাউন্ডারিতে ঘুচিয়েছিলেন মাহমুদউল্লাহ। ভক্তের ভিডিওতে যেখানে মুশফিকের একটি ইনিংস মনে করিয়ে দেয়া হয়েছে, সেখানে মাহমুদউল্লাহর একাধিক। এর মধ্যে একটি ইনিংস ৪২ বলে অপরাজিত ২১ রানের মাত্র কিন্তু কার্যকারিতায় যে সেটি সেঞ্চুরির চেয়েও বেশি! চট্টগ্রামে ২০১১-র বিশ্বকাপ ম্যাচে ইংল্যান্ডের ২২৫ রান তাড়া করতে নামা বাংলাদেশ ১৬৯ রানে ৮ উইকেট হারিয়ে তো হারের পথেই ছিল। কিন্তু সেখান থেকে পেসার শফিউল ইসলামকে নিয়ে নবম উইকেটে মাহমুদউল্লাহর অবিচ্ছিন্ন ৫৮ রানের পার্টনারশিপেই মাস্টারদা সূর্যসেনের শহরে ‘ব্রিটিশ বধ’ করা গিয়েছিল শেষ পর্যন্ত। ২০১৫-র বিশ্বকাপেও সেই ইংলিশদের হারিয়েই প্রথমবারের মতো টাইগারদের কোয়ার্টার ফাইনাল খেলা নিশ্চিত হয়েছিল মাহমুদউল্লাহর সেঞ্চুরিতে। ওয়ানডে বিশ্বকাপের প্রথম বাংলাদেশি সেঞ্চুরিয়ান নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে পরের ম্যাচেও ছুঁয়েছিলেন তিন অঙ্কের ম্যাজিক ফিগার। যে ইনিংসে আরেকটু হলে টুর্নামেন্টের ফাইনালিস্ট কিউইদেরও হারিয়ে দিচ্ছিলেন সাকিব আল হাসানরা! অবশ্য ভক্তের ভিডিও দেখে দুজনেরই একই রকম প্রতিক্রিয়া হয়েছে ধরে নেয়ার ভুল ধরা পড়তেও সময় লাগল না। দেশে ফেরার পর বিমানবন্দরে মাহমুদউল্লাহর এ কথায় হেলদোলই নেই কোনো, ‘হ্যাঁ, মুশফিক আমাকে ভিডিওটি দেখিয়েছে।’ দেখে মুশফিক সান্ত¡না পেলেও তার ভায়রা ভাইয়ের অন্তর্দহন যে কমেনি, সেটি বুঝে নিতেও সমস্যা হয়নি, ‘আমি আসলে ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না যে ভিডিওটি দেখে স্বস্তি পেয়েছি কী পাইনি!’ ড্রাইভারের কাছ থেকে গাড়ির চাবি বুঝে নিয়ে নিজেই ড্রাইভিং সিটে বসে পড়ার আগে স্বীকারও করে গেলেন যে ভেতরটা পুড়ে এখনো খাক হয়ে চলেছে তার, ‘আমি আসলে এখনো খুব আপসেট। ব্যাপারটি একদমই ভুলতে পারছি না।’ ম্যাচ জেতানো অনেক ইনিংসের কথা মনে করিয়ে দেয়ার পরও পারছেন না যখন, তখন মাহমুদউল্লাহর কষ্টের পরিমাপও খুব কঠিন কিছু নয়!
Info: http://www.dailysangram.com

No comments:

Post a Comment