আঁকাবাঁকা অপ্রশস্ত পাকা সড়ক চলে
গেছে নিঝুম-নিস্তব্ধ-নিভৃত
পল্লী নওগাঁর
আত্রাই উপজেলার
মুনিয়ারী ইউনিয়নে
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুরের কুঠিবাড়ীতে।
বাংলা সাহিত্যের
কিংবদন্তি রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের সিংহভাগই
কাটিয়েছেন পদ্মা, ইছামতী, আত্রাই ও
নাগর নদীবিধৌত
উত্তরবঙ্গের সবুজ শ্যামল ছায়াঘেরা প্রাকৃতিক
অপরূপ সৌন্দর্যে
ভরা নওগাঁর
পতিসরে।
এই পতিসর
জেলা সদর
থেকে ৩৫
কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণে অবস্থিত। এখানে
রয়েছে কবিগুরুর
কুঠিবাড়ী। কুঠিবাড়ীতে প্রবেশের প্রধান গেটটি
প্রতিটি দর্শনার্থীর
নজর কাড়ে।
ভেতরে প্রবেশ
করতেই চোখে
পড়ে সিংহদ্বারবিশিষ্ট
একটি পাঁচিলঘেরা
চত্বরের ভেতর
প্রথমে বৈঠক
ঘর। এছাড়া
বাইরে বকুল
ও অদূরে
দুটি তালগাছ
ছিল। কিন্তু
কি এক
আশ্চর্য কারণে
কবিগুরু যাওয়ার
কিছুদিন পর
তালগাছগুলো মারা যায়। তবে তাঁর
গোসল করার
কাজে ব্যবহার্য
বাথটবটি এখনও
অক্ষত অবস্থায়
রয়েছে। দীর্ঘসময়
এটি এক
গৃহস্থের বাড়িতে
গরুর খাবারের
পাত্র হিসেবে
ব্যবহৃত হচ্ছিল।
সম্প্রতি এটি
উদ্ধার করে
কুঠিবাড়ীর অভ্যন্তরে স্থাপন করা হয়েছে।
কবির প্রিয়
সরোবর ঘাটটির
সংস্কার করা
হয়েছে। সরোবরের
চারধারে নতুন
করে বকুল
ও কাঁঠালগাছ
লাগানো হয়েছে।
বাড়ির ভেতরে
বর্তমানে একটি
জাদুঘর গড়ে
তোলা হয়েছে।
এতে কবির
জীবনকালের কিছু আলোকচিত্র ও ব্যবহৃত
সামগ্রী প্রদর্শিত
হচ্ছে।
মূলত কবিগুরু
এখানে এসেছিলেন
জমিদারি পরিচালনা
করতে। তবু
তাঁর সাহিত্যিক
জীবনের অনেক
রসদ তিনি
সংগ্রহ করেছিলেন
এই প্রকৃতিভাণ্ডার
থেকেই। এখানকার
প্রকৃতি ও
সরল মানুষজন
দেখে মুগ্ধ
হয়েছিলেন কবিগুরু।
কবির প্রিয়
নাগর নদী
কুঠিবাড়ীর সীমানা ছুঁয়ে এঁকেবেঁকে চলে
গেছে। সামান্য
ব্যবধানে এই
নদী বিভাজিত
করেছে তিন
জেলার উপজেলাকে।
বগুড়ার নন্দীগ্রাম,
নাটোরের সিংড়া
ও নওগাঁর
আত্রাই।
কবিগুরুর জন্মদিন উপলক্ষে প্রতিবছরই কুঠিবাড়ীতে
বসে মানুষের
মিলনমেলা। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়।
কবির স্মৃতিবিজড়িত
পতিসরে এবার
তাঁর জন্মবার্ষিকী
পালন উপলক্ষে
ইতোমধ্যে জেলা
প্রশাসক সব
প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন।
পতিসরে কবিগুরুর আসা ইচ্ছাকৃত নয়,
অনেকটা ভাগ্যক্রমে।
এজমালি সম্পত্তির
সর্বশেষ ভাগে
বিরাহিমপুর ও কালীগ্রাম পরগনার মধ্যে
সত্যেন্দ্রপুত্র সুরেন্দ্রনাথকে তাঁর পছন্দের অংশ
বেছে নিতে
বললে তিনি
বিরাহিমপুর পছন্দ করেন। রবীন্দ্রনাথের অংশ
এসে পড়ে
কালীগ্রাম পরগনায়। যার সদর দফতর
আত্রাই উপজেলার
পতিসরে। এই
পতিসরের পূর্ব-দক্ষিণে চলনবিল
ও আত্রাই
নদী। পশ্চিম-উত্তরে রক্তদহ
বিল। তখন
গ্রামগুলোকে মনে হতো এক একটি
বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। তিনি সর্বপ্রথম এই
বিচ্ছিন্ন দ্বীপে আসেন ১৮৯১ সালে।
এখানকার প্রাকৃতিক
সৌন্দর্য কবিগুরুকে
মুগ্ধ করে।
তার জমিদারি
পরিচালনার পদ্ধতিও ছিল আধুনিক ও
বিজ্ঞানসম্মত। তিনি অনুন্নত পরগনার রাস্তাঘাট,
শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা,
দারিদ্র্য বিমোচন, ব্যাংক স্থাপন, কূপ,
দিঘি ও
পুকুর খনন,
গ্রাম্য সালিশির
ব্যবস্থা ও
মহাজনের সুদের
হাত থেকে
দরিদ্র প্রজাদের
রক্ষাসহ নানাবিধ
উন্নয়নমূলক কর্মসূচি হাতে নেন।
এসব কর্মসূচি
বাস্তবায়নের জন্য পরগনাকে তিনটি বিভাগে
ভাগ করেন
কবিগুরু। কালীগ্রাম
‘হিতৈষী সভা’
নামে একটি
সংগঠন তৈরি
করেন। কালীগ্রাম
পরগনার প্রজাদের
শিক্ষার আলোয়
আলোকিত করার
জন্য রবীন্দ্রনাথ
১৯১৩ সালে
পতিসর, রাতোয়াল
ও কামতা
তিনটি বিভাগে
তিনটি মধ্য
ইংরেজি স্কুল
ও পতিসরে
ছেলে রথীন্দ্রনাথের
নামে একটি
স্কুল স্থাপন
করেন। স্কুলের
ভবন, ছাত্রাবাস
নির্মাণ ও
অন্যান্য খরচ
এস্টেট থেকে
বহন করা
হতো। পতিসরে
অবস্থিত কালীগ্রাম
রথীন্দ্রনাথ ইনস্টিটিউশনের প্রথমে নাম ছিল
পতিসর এমই
স্কুল। ১৯৩৭
সালে বিদ্যালয়টি
হাইস্কুলে রূপান্তরিত হয়। এটি ছিল
নওগাঁ জেলার
তৃতীয় স্কুল।
যা আজও
স্বমহিমায় বিদ্যমান।
বিশ্বকবি পতিসরে বসেই গোরা ও
ঘরে বাইরে (অংশবিশেষ)
উপন্যাস, ছোটগল্প
‘প্রতিহিংসা’ ও ‘ঠাকুরদা’ লেখার রসদ
পেয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, এই
পতিসরে বসেই
রচনা করেছেন
চৈতালি কাব্যের ৫৪টি কবিতা। রচনা
করেছিলেন কিছু
হৃদয়স্পর্শী গান। যেমন, বিধি ডাগর
আঁখি/ জলে
ডোবা চিকন
শ্যামল/ বধূ
মিছে রাগ
করো না/
আমি কান
পেতে রই।
একদা এই
নাগর নদীতেই
পদ্ম বোটে
বসে কবি
রচনা করেছিলেন
‘তালগাছ এক
পায়ে দাঁড়িয়ে’। কিন্তু
কবির সেই
তালগাছ আর
নেই। ১৯৬২
সালে প্রবল
ঝড়ে সেই
তালগাছটি ভেঙে
পড়ে। গাছটির
স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে সেখানে রয়েছে একটি
মাটির ঢিবি।
নতুন করে
একটি শিশু
তালগাছ গজিয়ে
তার স্মৃতি
জানান দিচ্ছে। ১৮৩৭
থেকে ১৯৩৭
সাল পর্যন্ত
রবীন্দ্রনাথ জমিদারি পরিচালনা করেছিলেন পতিসরে।
প্রিয় পতিসরকে
রেখে ১৯৩৭
সালে অশ্রুসিক্ত
চোখে কবি
শেষবারের মতো
বিদায় নিলেন।
মানুষ কাঁদলেন,
কবি নিজেও
কাঁদলেন।
শেষ বিদায়
স্মরণীয় করে
রাখার জন্য
কবির ৭৬
বছর বয়সের
একটি উন্মুক্ত
ভাস্কর্য স্থাপনের
কাজ শেষ
হয়েছে। ভাস্কর্যটি
রবীন্দ্র গবেষক
প্রফেসর ড.
গোলাম জাকারিয়ার
আর্থিক সহযোগিতায়
নির্মাণ করা
হয়েছে।
পতিসরে ১৯৮৬ সালে একটি রবীন্দ্র
সাহিত্য পরিষদ
গড়ে তোলা
হয়। এখানে
অনেক দুর্লভ
বই রয়েছে।
ইতোমধ্যে প্রত্নতত্ত্ব
বিভাগ সাড়ে
৮ লাখ
টাকা ব্যয়ে
মূল ভবনের
সংস্কার করেছে।
জেলা প্রশাসকের
উদ্যোগে কবিগুরুর
ব্যবহৃত একটি
পালঙ্ক, বজরার
একটি আয়না,
একটি টেবিল
ও একটি
দেয়ালঘড়ি সংগ্রহ
করে কুঠিবাড়ীতে
প্রদর্শনের জন্য সংরক্ষণ করা হয়েছে।
উঠোনের ঠিক
মাঝখানে কবির
৩৭ বছর
বয়সের একটি
ভাস্কর্য স্থাপন
করা হয়েছে,
স্থায়ী দেবেন্দ্র
মঞ্চ নির্মিত
হয়েছে। স্থাপিত
হয়েছে রবীন্দ্রনাথ
সাহিত্য পরিষদ,
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ
কৃষি কলেজ,
জাদুঘর ও
ডাকবাংলো।
- See more at:https://www.blogger.com/blogger.g
আঁকাবাঁকা
অপ্রশস্ত পাকা সড়ক চলে গেছে নিঝুম-নিস্তব্ধ-নিভৃত পল্লী নওগাঁর আত্রাই
উপজেলার মুনিয়ারী ইউনিয়নে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়ীতে। বাংলা
সাহিত্যের কিংবদন্তি রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের সিংহভাগই কাটিয়েছেন পদ্মা,
ইছামতী, আত্রাই ও নাগর নদীবিধৌত উত্তরবঙ্গের সবুজ শ্যামল ছায়াঘেরা
প্রাকৃতিক অপরূপ সৌন্দর্যে ভরা নওগাঁর পতিসরে।
এই পতিসর জেলা সদর থেকে ৩৫ কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণে অবস্থিত। এখানে রয়েছে কবিগুরুর কুঠিবাড়ী। কুঠিবাড়ীতে প্রবেশের প্রধান গেটটি প্রতিটি দর্শনার্থীর নজর কাড়ে। ভেতরে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে সিংহদ্বারবিশিষ্ট একটি পাঁচিলঘেরা চত্বরের ভেতর প্রথমে বৈঠক ঘর। এছাড়া বাইরে বকুল ও অদূরে দুটি তালগাছ ছিল। কিন্তু কি এক আশ্চর্য কারণে কবিগুরু যাওয়ার কিছুদিন পর তালগাছগুলো মারা যায়। তবে তাঁর গোসল করার কাজে ব্যবহার্য বাথটবটি এখনও অক্ষত অবস্থায় রয়েছে। দীর্ঘসময় এটি এক গৃহস্থের বাড়িতে গরুর খাবারের পাত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছিল। সম্প্রতি এটি উদ্ধার করে কুঠিবাড়ীর অভ্যন্তরে স্থাপন করা হয়েছে।
কবির প্রিয় সরোবর ঘাটটির সংস্কার করা হয়েছে। সরোবরের চারধারে নতুন করে বকুল ও কাঁঠালগাছ লাগানো হয়েছে। বাড়ির ভেতরে বর্তমানে একটি জাদুঘর গড়ে তোলা হয়েছে। এতে কবির জীবনকালের কিছু আলোকচিত্র ও ব্যবহৃত সামগ্রী প্রদর্শিত হচ্ছে।
মূলত কবিগুরু এখানে এসেছিলেন জমিদারি পরিচালনা করতে। তবু তাঁর সাহিত্যিক জীবনের অনেক রসদ তিনি সংগ্রহ করেছিলেন এই প্রকৃতিভাণ্ডার থেকেই। এখানকার প্রকৃতি ও সরল মানুষজন দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন কবিগুরু। কবির প্রিয় নাগর নদী কুঠিবাড়ীর সীমানা ছুঁয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে। সামান্য ব্যবধানে এই নদী বিভাজিত করেছে তিন জেলার উপজেলাকে। বগুড়ার নন্দীগ্রাম, নাটোরের সিংড়া ও নওগাঁর আত্রাই।
কবিগুরুর জন্মদিন উপলক্ষে প্রতিবছরই কুঠিবাড়ীতে বসে মানুষের মিলনমেলা। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। কবির স্মৃতিবিজড়িত পতিসরে এবার তাঁর জন্মবার্ষিকী পালন উপলক্ষে ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসক সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন।
পতিসরে কবিগুরুর আসা ইচ্ছাকৃত নয়, অনেকটা ভাগ্যক্রমে। এজমালি সম্পত্তির সর্বশেষ ভাগে বিরাহিমপুর ও কালীগ্রাম পরগনার মধ্যে সত্যেন্দ্রপুত্র সুরেন্দ্রনাথকে তাঁর পছন্দের অংশ বেছে নিতে বললে তিনি বিরাহিমপুর পছন্দ করেন। রবীন্দ্রনাথের অংশ এসে পড়ে কালীগ্রাম পরগনায়। যার সদর দফতর আত্রাই উপজেলার পতিসরে। এই পতিসরের পূর্ব-দক্ষিণে চলনবিল ও আত্রাই নদী। পশ্চিম-উত্তরে রক্তদহ বিল। তখন গ্রামগুলোকে মনে হতো এক একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। তিনি সর্বপ্রথম এই বিচ্ছিন্ন দ্বীপে আসেন ১৮৯১ সালে। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কবিগুরুকে মুগ্ধ করে। তার জমিদারি পরিচালনার পদ্ধতিও ছিল আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত। তিনি অনুন্নত পরগনার রাস্তাঘাট, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, দারিদ্র্য বিমোচন, ব্যাংক স্থাপন, কূপ, দিঘি ও পুকুর খনন, গ্রাম্য সালিশির ব্যবস্থা ও মহাজনের সুদের হাত থেকে দরিদ্র প্রজাদের রক্ষাসহ নানাবিধ উন্নয়নমূলক কর্মসূচি হাতে নেন।
এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য পরগনাকে তিনটি বিভাগে ভাগ করেন কবিগুরু। কালীগ্রাম ‘হিতৈষী সভা’ নামে একটি সংগঠন তৈরি করেন। কালীগ্রাম পরগনার প্রজাদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার জন্য রবীন্দ্রনাথ ১৯১৩ সালে পতিসর, রাতোয়াল ও কামতা তিনটি বিভাগে তিনটি মধ্য ইংরেজি স্কুল ও পতিসরে ছেলে রথীন্দ্রনাথের নামে একটি স্কুল স্থাপন করেন। স্কুলের ভবন, ছাত্রাবাস নির্মাণ ও অন্যান্য খরচ এস্টেট থেকে বহন করা হতো। পতিসরে অবস্থিত কালীগ্রাম রথীন্দ্রনাথ ইনস্টিটিউশনের প্রথমে নাম ছিল পতিসর এমই স্কুল। ১৯৩৭ সালে বিদ্যালয়টি হাইস্কুলে রূপান্তরিত হয়। এটি ছিল নওগাঁ জেলার তৃতীয় স্কুল। যা আজও স্বমহিমায় বিদ্যমান।
বিশ্বকবি পতিসরে বসেই গোরা ও ঘরে বাইরে (অংশবিশেষ) উপন্যাস, ছোটগল্প ‘প্রতিহিংসা’ ও ‘ঠাকুরদা’ লেখার রসদ পেয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, এই পতিসরে বসেই রচনা করেছেন চৈতালি কাব্যের ৫৪টি কবিতা। রচনা করেছিলেন কিছু হৃদয়স্পর্শী গান। যেমন, বিধি ডাগর আঁখি/ জলে ডোবা চিকন শ্যামল/ বধূ মিছে রাগ করো না/ আমি কান পেতে রই। একদা এই নাগর নদীতেই পদ্ম বোটে বসে কবি রচনা করেছিলেন ‘তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে’। কিন্তু কবির সেই তালগাছ আর নেই। ১৯৬২ সালে প্রবল ঝড়ে সেই তালগাছটি ভেঙে পড়ে। গাছটির স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে সেখানে রয়েছে একটি মাটির ঢিবি। নতুন করে একটি শিশু তালগাছ গজিয়ে তার স্মৃতি জানান দিচ্ছে।
পল্লীর উন্নয়ন ও কর্মপরিকল্পনার রূপকার ছিলেন বিশ্বকবি। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য তিনি সমবায় পদ্ধতিতে ১৯০৫ সালে নওগাঁর পতিসরে কৃষি ব্যাংক স্থাপন করেন। নোবেল পুরস্কারের পাওয়া ১ লাখ ৮ হাজার টাকা এই ব্যাংকে বিনিয়োগ করা হয়।
- See more at: http://bangla.thereport24.com/article/49781/index.html#sthash.zSzsogk4.dpuf
এই পতিসর জেলা সদর থেকে ৩৫ কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণে অবস্থিত। এখানে রয়েছে কবিগুরুর কুঠিবাড়ী। কুঠিবাড়ীতে প্রবেশের প্রধান গেটটি প্রতিটি দর্শনার্থীর নজর কাড়ে। ভেতরে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে সিংহদ্বারবিশিষ্ট একটি পাঁচিলঘেরা চত্বরের ভেতর প্রথমে বৈঠক ঘর। এছাড়া বাইরে বকুল ও অদূরে দুটি তালগাছ ছিল। কিন্তু কি এক আশ্চর্য কারণে কবিগুরু যাওয়ার কিছুদিন পর তালগাছগুলো মারা যায়। তবে তাঁর গোসল করার কাজে ব্যবহার্য বাথটবটি এখনও অক্ষত অবস্থায় রয়েছে। দীর্ঘসময় এটি এক গৃহস্থের বাড়িতে গরুর খাবারের পাত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছিল। সম্প্রতি এটি উদ্ধার করে কুঠিবাড়ীর অভ্যন্তরে স্থাপন করা হয়েছে।
কবির প্রিয় সরোবর ঘাটটির সংস্কার করা হয়েছে। সরোবরের চারধারে নতুন করে বকুল ও কাঁঠালগাছ লাগানো হয়েছে। বাড়ির ভেতরে বর্তমানে একটি জাদুঘর গড়ে তোলা হয়েছে। এতে কবির জীবনকালের কিছু আলোকচিত্র ও ব্যবহৃত সামগ্রী প্রদর্শিত হচ্ছে।
মূলত কবিগুরু এখানে এসেছিলেন জমিদারি পরিচালনা করতে। তবু তাঁর সাহিত্যিক জীবনের অনেক রসদ তিনি সংগ্রহ করেছিলেন এই প্রকৃতিভাণ্ডার থেকেই। এখানকার প্রকৃতি ও সরল মানুষজন দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন কবিগুরু। কবির প্রিয় নাগর নদী কুঠিবাড়ীর সীমানা ছুঁয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে। সামান্য ব্যবধানে এই নদী বিভাজিত করেছে তিন জেলার উপজেলাকে। বগুড়ার নন্দীগ্রাম, নাটোরের সিংড়া ও নওগাঁর আত্রাই।
কবিগুরুর জন্মদিন উপলক্ষে প্রতিবছরই কুঠিবাড়ীতে বসে মানুষের মিলনমেলা। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। কবির স্মৃতিবিজড়িত পতিসরে এবার তাঁর জন্মবার্ষিকী পালন উপলক্ষে ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসক সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন।
পতিসরে কবিগুরুর আসা ইচ্ছাকৃত নয়, অনেকটা ভাগ্যক্রমে। এজমালি সম্পত্তির সর্বশেষ ভাগে বিরাহিমপুর ও কালীগ্রাম পরগনার মধ্যে সত্যেন্দ্রপুত্র সুরেন্দ্রনাথকে তাঁর পছন্দের অংশ বেছে নিতে বললে তিনি বিরাহিমপুর পছন্দ করেন। রবীন্দ্রনাথের অংশ এসে পড়ে কালীগ্রাম পরগনায়। যার সদর দফতর আত্রাই উপজেলার পতিসরে। এই পতিসরের পূর্ব-দক্ষিণে চলনবিল ও আত্রাই নদী। পশ্চিম-উত্তরে রক্তদহ বিল। তখন গ্রামগুলোকে মনে হতো এক একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। তিনি সর্বপ্রথম এই বিচ্ছিন্ন দ্বীপে আসেন ১৮৯১ সালে। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কবিগুরুকে মুগ্ধ করে। তার জমিদারি পরিচালনার পদ্ধতিও ছিল আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত। তিনি অনুন্নত পরগনার রাস্তাঘাট, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, দারিদ্র্য বিমোচন, ব্যাংক স্থাপন, কূপ, দিঘি ও পুকুর খনন, গ্রাম্য সালিশির ব্যবস্থা ও মহাজনের সুদের হাত থেকে দরিদ্র প্রজাদের রক্ষাসহ নানাবিধ উন্নয়নমূলক কর্মসূচি হাতে নেন।
এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য পরগনাকে তিনটি বিভাগে ভাগ করেন কবিগুরু। কালীগ্রাম ‘হিতৈষী সভা’ নামে একটি সংগঠন তৈরি করেন। কালীগ্রাম পরগনার প্রজাদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার জন্য রবীন্দ্রনাথ ১৯১৩ সালে পতিসর, রাতোয়াল ও কামতা তিনটি বিভাগে তিনটি মধ্য ইংরেজি স্কুল ও পতিসরে ছেলে রথীন্দ্রনাথের নামে একটি স্কুল স্থাপন করেন। স্কুলের ভবন, ছাত্রাবাস নির্মাণ ও অন্যান্য খরচ এস্টেট থেকে বহন করা হতো। পতিসরে অবস্থিত কালীগ্রাম রথীন্দ্রনাথ ইনস্টিটিউশনের প্রথমে নাম ছিল পতিসর এমই স্কুল। ১৯৩৭ সালে বিদ্যালয়টি হাইস্কুলে রূপান্তরিত হয়। এটি ছিল নওগাঁ জেলার তৃতীয় স্কুল। যা আজও স্বমহিমায় বিদ্যমান।
বিশ্বকবি পতিসরে বসেই গোরা ও ঘরে বাইরে (অংশবিশেষ) উপন্যাস, ছোটগল্প ‘প্রতিহিংসা’ ও ‘ঠাকুরদা’ লেখার রসদ পেয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, এই পতিসরে বসেই রচনা করেছেন চৈতালি কাব্যের ৫৪টি কবিতা। রচনা করেছিলেন কিছু হৃদয়স্পর্শী গান। যেমন, বিধি ডাগর আঁখি/ জলে ডোবা চিকন শ্যামল/ বধূ মিছে রাগ করো না/ আমি কান পেতে রই। একদা এই নাগর নদীতেই পদ্ম বোটে বসে কবি রচনা করেছিলেন ‘তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে’। কিন্তু কবির সেই তালগাছ আর নেই। ১৯৬২ সালে প্রবল ঝড়ে সেই তালগাছটি ভেঙে পড়ে। গাছটির স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে সেখানে রয়েছে একটি মাটির ঢিবি। নতুন করে একটি শিশু তালগাছ গজিয়ে তার স্মৃতি জানান দিচ্ছে।
পল্লীর উন্নয়ন ও কর্মপরিকল্পনার রূপকার ছিলেন বিশ্বকবি। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য তিনি সমবায় পদ্ধতিতে ১৯০৫ সালে নওগাঁর পতিসরে কৃষি ব্যাংক স্থাপন করেন। নোবেল পুরস্কারের পাওয়া ১ লাখ ৮ হাজার টাকা এই ব্যাংকে বিনিয়োগ করা হয়।
- See more at: http://bangla.thereport24.com/article/49781/index.html#sthash.zSzsogk4.dpuf
No comments:
Post a Comment