মে দিবস শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের দিবস । বিশ্বের শ্রমজীবি মানুষের
অধিকার আদায়ে ১২৭ বছর আগে শ্রমিকদের ঐতিহাসিক আন্দোলনের পর থেকে এই দিনটি
বিশ্বব্যাপী শ্রমিকের দিন হিসেবে পরিচিত হয়ে আসছে। ১৮৮৬ সালের ১ মে
যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটে শ্রমের উপযুক্ত মূল্য এবং দৈনিক
আট ঘন্টা কাজের দাবিতে আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর পুলিশ গুলি চালালে অনেক
শ্রমিক হতাহত হন। ১৮৮৯ সালে প্যারিসে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলনে
দিবসটিকে ”মে দিবস” হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত হয়। আর কত মে দিবস পালিত হলে
এইসব অসহায় নারী শ্রমিকদের শ্রমের সঠিক মূল্যায়ন করা হবে?
২০০৪ সালের সরকারী পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে মোট শ্রমশক্তি ৪৪.৩
মিলিয়ন, যার মধ্যে নারী ৯.৮ মিলিয়ন। এপর এত পরিসংখ্যান অনুযায়ী মোট নারী
শ্রমিকের ৮৩%ভাগ গৃহশ্রমিক, ১০% ভাগ আত্মকর্মসংস্থান নিয়োজিত ৪%ভাগ
বেতনভোগী, ৩% ভাগ দিনমজুর। উক্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেখা যায় নারী শ্রমিকের
সিংহভাগ গৃহকর্মে নিয়োজিত। এই বিপুল সংখ্যক শ্রমজীবীকে এখনও পর্যন্ত
শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি এই শ্রমজীবী নারীরা নামমাত্র বেতনে কাজ
করে জীবিকা চালায়। নারীরা এখন নানা ধরণের কাজে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যেখানে
কম মজুরী দিতে হয়, কাজের ঘণ্টার কোন হিসাব নাই, যেখানে স্বাস্থ্য ঝুঁকি
অনেক বেশি সেখানেই নারী শ্রমিক এবং শিশু শ্রমিকের নিয়োগ দিতে দেখা যায়।
কর্মপরিবেশ, স্বাস্থ্য সেবা ও নিরাপত্তার কথা ২০০৬ সালের বাংলাদেশ শ্রম
আইনে থাকা সত্ত্বেও বেশির ভাগ পোশাক শিল্পে নিরাপত্তার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা
নেই। বাংলাদেশের পোশাক শিল্প টিকে আছে নারী শ্রমিকদের কারণে। নারী
শ্রমিকদের কর্মদক্ষতা, সততা, আন্তরিকতা এবং নিষ্ঠার মাধ্যমে পোশাক শিল্প আজ
বিশ্ব দরবারে মাথা উচু করে দাঁড়িয়েছে। একজন নারী শ্রমিক যে পরিমাণ শ্রম
দেয়, পাশাপাশি একজন পুরুষ শ্রমিক কিন্তু ততোটা শ্রম দেয় না। নারী শ্রমিকেরা
ফাঁকি দেয় কম, কাজ করে বেশী। যখন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পোশাক সরবরাহ করতে
হয়, তখন নারী শ্রমিকরা দিন রাত পরিশ্রম করেন। নারীদের একদিকে থাকে সংসার,
সন্তান, পারিবারিক কাজ কর্ম অপরদিকে থাকে অফিস। শত ঝড় ঝঞ্জা মাথায় নিয়ে
নির্বিকারচিত্তে কাজ করে যায় নারী শ্রমিকেরা। তারপরও তারা এত বেশী অবহেলিত
কেন? কেউবা অল্প শিক্ষায় শিক্ষিত, কেউবা নিরক্ষর। কিন্তু শ্রম দেয়ার বেলায়
শিক্ষিত শ্রমিকের চাইতে কোন অংশে কম শ্রম দিচ্ছে না। ওদের শ্রমকে পুজি করে
মালিকগণ হচ্ছে কোটিপতি। অথচ এইসব নারী শ্রমিকদের ন্যূনতম মূল্যায়ন করা হয়
না। কেন দিনের পর দিন ওদেরকে এভাবে অবমূল্যায়ন করা হবে? তারা লেখাপড়া কম
জানে বলে কিংবা হিসাব কম বোঝে বলে তাদের ওভারটাইমের বেতন কর্তন করে রাখা হয়
নানা অছিলায়। বেশীরভাগ পোশাক শিল্পে দেখা যায়, দুপুরের লাঞ্চ করার জন্য
ছাদ বরাদ্দ করা হয়ে থাকে। এই ছাদে নারী শ্রমিকদের দুপুরের কড়া রোদ্রে বসে
লাঞ্চ করতে হয়। যাদের মাধ্যমে মালিক এত আয় উন্নতি করছে, তাদের খাওয়ার জন্য
একটা লাঞ্চ রুমও কি করা যায় না? হতে পারে একসাথে এতজন কর্মীর জন্য একটি
লাঞ্চ রুম মোটেও যথেষ্ট হতে পারে না। তাহলে দুই কিংবা তিন দলে বিভক্ত হয়ে
লাঞ্চ করবে। তারপরও তো তারা একটু শারীরিক এবং মানসিকভাবে সুস্থতার সহিত
লাঞ্চ করবে। সকাল থেকে একটানা পরিশ্রমের ফলে শান্তিভাবে একটু খেতে বসারও
অধিকার ওদের নেই। কারণ ওরা অল্প আয়ের শ্রমিক। এমন অনেক গার্মেন্টস কর্মীকে
দেখেছি, পরিবারের মুখে অন্ন তুলে দেয়ার জন্য নিজে দিনের পর দিন অভূক্ত
থাকে। দুপুরে লাঞ্চ করে না। মালিক পক্ষ কি কোনদিনও এসব অসহায় কর্মীদের খবর
রাখে। মানুষ হয়ে জন্মালেই মানুষ বলে পরিচিত হয় না। মানবতা বোধ বিবর্জিত
মানুষকে কখনও মানুষ হিসাবে গণ্য করা হয় না। মনে রাখা দরকার, আজ ওদের শ্রম
পুজি করেই এত বড় বড় দালানকোঠা, গাড়ি বাড়ি হয়েছে। নিজে না বদলালে বদলাবে না
কিছুই। যে কোন একজন এগিয়ে আসুন। দেখিয়ে দিন আপনারাও পারেন গার্মেন্টস
কর্মীদের সুস্থ, সুন্দর জীবনের প্রতিশ্র“তি দিতে। কারণ ওরাও মানুষ।
সবকিছুতে ওদেরও আছে সম অধিকার।
এদেশে এখন বহু নারী নিজে কষ্ট করে নানা ধরণের জীবন-জীবিকার মাধ্যমে
সংসার চালায়। এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নারী খেয়ে না খেয়ে তার সংসার চালাচ্ছে।
নারীদের অসংখ্য কাজ বিশেষ করে গৃহস্থালি কাজ এবং শিশু লালন-পালন করতে হয়।
অধিকাংশ সমাজে গৃহস্থালি কাজের কোন মজুরি নেই, ব্যক্তিগতভাবে করে এবং
নারীরাই করে। গবেষণা সংস্থা ক্যাম্পেইন ফর সাস্টেইন্যাবল রুরাল লাইভলিহুডস
(সিএসআরএল)-এর বরাতে বলা হয়েছে কৃষি খাতে নিয়োজিত নারী শ্রমিকের ৭২ শতাংশই
অবৈতনিক। এদেরকে ‘পারিবারিক নারী শ্রমিক’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। গত
এক দশকে অর্থনৈতিক কার্যক্রমে ১ কোটি ৩০ লাখ বাড়তি শ্রমশক্তি যুক্ত হয়েছে,
যার মধ্যে ৫০ লাখ নারী। গৃহশ্রমে নিয়োজিত নারীদের বালা হয় গৃহিণী। আজও
বাংলাদেশে গৃহিণী পেশার মর্যাদা পায়নি মূল্যায়িত হয়নি নারীর গৃহকেন্দ্রিক
কর্মকান্ড। গৃহকর্মের এই অবমূল্যায়নের নারীকে চিহ্নিত করে রেখেছে বেকার
নিষ্ক্রিয়রূপে। ঘরকন্না, গৃহবধূ, গৃহিণী ঘরনী ইত্যাদি নামে আখ্যায়িত করে
তাদের প্রকৃত শ্রমকে বাদ দেয়া হয়েছে রাষ্ট্রের মোট শ্রমশক্তি থেকে।
গৃহস্থালি কাজ ছাড়াও চাষাবাদ ও শস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ইত্যাদি নারীর
প্রাকৃতিক কাজ হিসেবেই গণ্য করা হয়। প্রতিনিয়ত কুটির শিল্পজাত জিনিসপত্র
তৈরি করে, ঢেঁকিতে ধান ভেনেও গৃহিণী কোন মজুরিযোগ্য কাজের স্বীকৃতি পাননি।
অথচ একই কাজ নতুন প্রযুক্তি দিয়ে জীবিকার কারখানায় করা হলে তার সঙ্গে
জড়িতদের মজুরিযোগ্য শ্রমিক বলে গণ্য করা হয়। তাই নারীদের গৃহশ্রমিকের কাজের
স্বীকৃতি অর্জনের জন্য সামাজিক মূল্যবোধের পরিবর্তন প্রয়োজন। ব্যাপক নারী
শ্রমকে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হলেও অর্থমূল্যে জাতীয়
আয় হিসেবে দেখানো হয় না ।
সমাজ কাঠামোর পরিবর্তনের সাথে সাথে বদলে যাচ্ছে মানুষের জীবনাচারন,
পারষ্পরিক সম্পর্ক, মূল্যবোধ। সমাজ এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় পরিবর্তিত
হবার মাধ্যমে প্রতিনিয়তই বদলে যাচ্ছে সামাজিক সম্পর্কের মাত্রা ও তার
ব্যঞ্জনা। এতে পুরুষের যেমন ভূমিকা রয়েছে তেমনি নারীরও রয়েছে।
দারিদ্র্যপীড়িত বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ অধিক মাত্রায় বি¯তৃত
ও স্বীকৃত হয়েছে মূলত শ্রমিক হিসেবে। আর শ্রম দেয়ার ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে
কংক্রিট ভবন নির্মাণে নারীর অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য। ভোর হতে শুরু করে
সন্ধ্যা অবধি দারিদ্র্যপীড়িত নারী শ্রমিক মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ভবন
নির্মাণ-বিনির্মাণের কাজে নিজেকে যুক্ত রাখছে। এই কাজে দেখা যায়, নারী কখনো
কখনো পুরুষের তুলনায় শ্রম বেশী দিচ্ছে কিন্তু নানাভাবে বৈষম্যের শিকার
হচ্ছে। যৌন হয়রানিসহ নানাবিধ সমস্যা তাদেরকে ঘিরে রয়েছে। এছাড়া আয়
কর্মসংস্থানমূলক কর্মে যুক্ত হওয়ার ফলে সমাজে তার চিরায়ত গৃহবধূর ভূমিকাও
বদলে যাচ্ছে। সর্বোপরি সামাজিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারীর শ্রম বিশেষ
অবদান রাখছে। কিন্তু শ্রম হিসেবে নারীর শ্রমকে খাটো করে দেখার প্রবণতা আজো
রয়ে গেছে।
আবহমান কাল থেকে বাংলাদেশের পরিচয় গ্রাম প্রধান তথা কৃষিপ্রধান দেশ
হিসেবে। শস্য শ্যামল বাংলাদেশের সেই সবুজ গ্রাম থেকে কে আসতে চায় ইট পাথরের
যান্ত্রিক নগরে। তারপরও মানুষকে ছুটে আসতে হচ্ছে শহরে। প্রতিদিনই গ্রাম
ছেড়ে শহরে আসা মানুষ বাড়ছে নগরী-মহানগরীতে। দু-মুঠো ভাতের তাড়নায় শহরের
দিকে চলে আসে এসব নারী শ্রমিক। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেই এরা আসে।
গ্রামে যোগ্য পারিশ্রমিক না পাওয়ার কারণেও শহরে আসা নারী শ্রমিকের সংখ্যা
ক্রমাগত হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া গ্রামে শুধুমাত্র ভিটে আছে, চাষাবাদের
কোন জমি নেই এবং মজুরি বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহই তাদের বেঁচে থাকার
একমাত্র উপায়। অথচ সারা বছর তারা কাজ পায় না। বছরের যে কদিন কাজ পায় তার
পারিশ্রমিকও খুবই সামান্য। বড়জোর ৪০/৫০ টাকা। এই টাকা দিয়ে পারিবারিক
চাহিদা মেটানো সম্ভব নয় বলে উল্লেখ করেছেন নির্মাণ কাজে যুক্ত নারী
শ্রমিকেরা। গ্রামে থাকতে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাতে হতো।
নারীদের অধঃস্তন করে রাখার পাশাপাশি সর্বত্রই নারীকে ঠকানোর আয়োজন
সবখানে লক্ষ্য করা যায়। শ্রমজীবি নারীরা বলেন, কর্মঘন্টা একই থাকলেও
কর্মক্ষেত্রে পুরুষ ও নারীর প্রতি বেতনের বৈষম্য রয়েছে। পুরুষ শ্রমিকরা
দিনের মোট কর্মঘন্টা থেকে এক থেকে দেড় ঘন্টা কাজ কম করে এবং বিভিন্ন অজুহাত
দিয়ে সময় নষ্ট করে। অথচ নারী শ্রমিকরা নিয়মানুসারে কাজ করে যায়। হিসেব
করলে বোঝা যায়, পুরুষ শ্রমিক থেকে নারী শ্রমিকরা কাজ বেশী করছে। বিভিন্ন
শারীরিক শ্রমে নিয়োজিত নারী শ্রমিককে পুরুষ শ্রমিকের তুলনায় কম পারিশ্রমিক
দেয়া হয়। যদিও প্রায়ই নারী শ্রমিককে নির্ধারিত সময়ের বাইরে আরো অধিক সময়
ধরে কাজ করতে হয়। কিন্তু কোনো অতিরিক্ত পারিশ্রমিক দেয়া হয় না। শ্রম আইন
এখানে অসহায়। জাতীয় উন্নয়নে নানা কর্মসূচী গ্রহণ করা হলেও এসব নারী
শ্রমিকদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। মূল্যায়িত করা হচ্ছে না তাদের
শ্রমকে।
তথ্যসূত্র:
http://thebuddhisttimes.com
No comments:
Post a Comment