সরকারি নিয়ম-নীতির বদলে গ্রামাঞ্চলে স্থানীয় রীতি মোতাবেক ভাগ চাষ হচ্ছে। এতে ভাগচাষীরা জমি মালিকদের কাছে শ্রম শোষণের শিকার হচ্ছেন।
ভাগচাষীদের উৎপাদিত ফসলের অর্ধেক ও চাষীরা মোট শ্রমের অর্ধেক বিনা হিসেবে জমি মালিকের গোলায় চলে যায়। ভাগচাষীরা জমি মালিকদের ভূমিদাসে পরিণত হয়।
জলাবদ্ধতার কারণে নোয়াখালীর অধিকাংশ জমি এক ফসলি জমিতে পরিণত হওয়ায় প্রান্তিক ও ভূমিহীন কৃষকদের বছরের বেশিরভাগ সময় বেকার থাকতে হয়। ফসলের মৌসুমে যে পরিমাণ কাজের লোক দরকার তার চাইতে বেশি পরিমাণ বেকার লোক পাওয়া যায়। ফলে গ্রামে কৃষিকাজের জন্য শ্রম বিক্রি করার সুযোগ থাকে না বিধায়ও অনেকে ভাগচাষ করে।
ভাগচাষীদের উৎপাদিত ফসলের অর্ধেক ও চাষীরা মোট শ্রমের অর্ধেক বিনা হিসেবে জমি মালিকের গোলায় চলে যায়। ভাগচাষীরা জমি মালিকদের ভূমিদাসে পরিণত হয়।
জলাবদ্ধতার কারণে নোয়াখালীর অধিকাংশ জমি এক ফসলি জমিতে পরিণত হওয়ায় প্রান্তিক ও ভূমিহীন কৃষকদের বছরের বেশিরভাগ সময় বেকার থাকতে হয়। ফসলের মৌসুমে যে পরিমাণ কাজের লোক দরকার তার চাইতে বেশি পরিমাণ বেকার লোক পাওয়া যায়। ফলে গ্রামে কৃষিকাজের জন্য শ্রম বিক্রি করার সুযোগ থাকে না বিধায়ও অনেকে ভাগচাষ করে।
ফসল ওঠার পর ভাগচাষীরা উৎপাদিত ফসলের অর্ধেক জমি মালিকদের ঘরে পৌঁছে দেয়। আর ভাগচাষীরা ফসলের উৎপাদন খরচ ও উৎপাদনের পেছনে ব্যয়িত শ্রমের বদলে অর্ধেক ফসল পায়। জমির মালিক জমি কেনার সময় মূলধন জাতীয় কাজের বিনিময়ে ভাগচাষীর উৎপাদিত ফসলের অর্ধেক ও ভাগচাষীর মোট শ্রমের অর্ধেক নিজের গোলায় ওঠিয়ে নেয়। অথচ ভাগচাষীদের এ শ্রমের কখনো মূল্য নির্ধারণ হয় না। এতে ভাগচাষীরা ফসল উৎপাদন মৌসুমে অন্যত্র শ্রম বিক্রি না করে ভাগের ফসলের আশায় বসে থাকার ফলে বছরের অধিকাংশ সময় অভাবে থাকতে হয়। এ অভাব ঘোচানোর জন্য অনেক ভাগচাষী মহাজনি ঋণ ও ব্যাংক ঋণ গ্রহণ করেন। এক সময় ঋণের জটিল চক্রে জড়িয়ে কৃষকদের me©¯^vš— হতে হয়।
১৯৮৪ সালে জারিকৃত ভূমি সংস্কার অধ্যাদেশের ভাগচাষীদের ¯^v_© সংরক্ষণের যে সকল ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে সেগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে ভাগচাষীদের শ্রম শোষণের হাত থেকে কিছু রক্ষা সম্ভব। নোয়াখালীর ভাগচাষী, জমি মালিক, স্থানীয় লোকজনের সাথে আলাপে এ তথ্য পাওয়া যায়।
গ্রামাঞ্চলে যাদের কোনো জমি নেই তারা অন্যদের জমি ভাগে বা বর্গা চাষ করে। এছাড়াও যাদের জমি কম এবং যারা ইতোপূর্বেও কৃষক ছিলেন কিন্তু বিভিন্ন কারণে জমি বিক্রি করে ফেলেছেন তারাও অন্যদের জমি ভাগ চাষ করে।
সরেজমিন পরিদর্শনকালে দেখা যায়, নোয়াখালীর একেক এলাকায় একেক নিয়মে ভাগ চাষ হয়ে থাকে। বড়রামদেবপুর আইপিএম ক্লাবের সহ-সভাপতি মাইন উদ্দিন জানান, যদি উৎপাদন খরচের অর্ধেক চাষী ও অর্ধেক মালিক দেয় তাহলে ফসল ভাগের সময় তা অর্ধেক অর্ধেক হয়। আবার উৎপাদনের সময় হালের খরচ, সার, বীজ, কীটনাশক ইত্যাদির খরচ চাষী দিলে উৎপাদিত ফসল তিনভাগ হয়। তিন ভাগের দুই ভাগ চাষী ও একভাগ জমির মালিক পায়। চাটখিলের মোহাম্মদপুর গ্রামের শাহ আলম জানান, চাটখিল উপজেলার কিছু জায়গায় ভাগচাষী ফসল চাষের সময় সার, বীজ, কীটনাশক, হালের খরচ সব দেয়। তারপর ফসল উঠলে জমির মালিক ফসল উৎপাদন খরচ বাবদ কিছু ধান ভাগচাষীকে দিয়ে দেয়। বাকি ফসল দু ভাগ করে একভাগ ভাগচাষী ও অন্যভাগ মালিক নিয়ে যায়। চাটখিলের শোলা গ্রামের বেলাল জানান, জমির মালিক পানি সেচ খরচ অথবা সারের খরচ দেয়। বাকি সব খরচ ভাগচাষীকেই দিতে হয়। কিন্তু ফসল ভাগ দুই ভাগেই হয়।
সোন্দলপুরের আবুল হোসেন বলেন, আমাদের এলাকার কিছু অংশে আরেক নিয়ম আছে। সেটি হলো যে জমিতে ধান ও রবিশস্য ফলে সেগুলো আর্থিক মূল্যে বর্গা দেওয়া হয়। যেমন জমিতে ধান আবার শীতে সবজি চাষ করা হয়। জমির মালিক একজনের কাছে জমিতে বর্গা দিয়ে বলেন, এ জমি থেকে তুমি বছরে যা উৎপাদন কর তা তোমার বিষয়। তবে আমাকে বছরে দুই হাজার টাকা দিতে হবে। এভাবে টাকা পরিশোধের মাধ্যমেও গ্রামাঞ্চলে ভাগ চাষ হয়ে থাকে। তবে এ জাতীয় চাষকে ঠিকা চুক্তিতে চাষও বলা হয়। অনেকে জানান, কৃষির কোনো উন্নতি ব্যতিরেকে বর্তমানের নিম্ন উৎপাদনে এই চুক্তিতে মালিকদের সুবিধা ভাগ চাষের চেয়ে বেশি।
ভাগচাষের জন্য একটি চুক্তি থাকার নিয়ম থাকলেও তা গ্রামাঞ্চলে মানা হয় না। বর্গাচাষী হোসেন মিয়ার গ্রাম সোন্দলপুরে। তিনি বলেন, আমাদের এলাকায় কোনো চুক্তি হয় না। মালিক মুখে বলে দেয় চাষ করার জন্য। এভাবে ভাগচাষীও চাষ করে।
শোলা গ্রামের বেলাল জানন, জমি মালিকও ভাগচাষী একই গ্রামের হওয়াতে তেমন কোনো সমস্যা হয় না। কিন্তু কোনো কারণে যদি দুজনের মধ্যে কোনো রকম সমস্যা দেখা দেয় তখন চুক্তির দরকার হয়। কিন্তু সে সময় চুক্তিও থাকে না। ফলে জমির মালিক যা বলে তাই হয়।
লিখিত চুক্তির বিষয়ে জানতে গিয়ে দেখা যায়, জমি মালিক ও ভাগচাষী উভয়ই বিষয়টি হালকা চোখে দেখে। বিশেষত জমির মালিকরা মনে করেন, আমার জমিন আমি বর্গা দেব, তাতে চুক্তি করব না।
অনেক ভাগচাষী চুক্তি করার নিয়মের কথা জানলেও তারা তা বলে না। এ না বলার পেছনে এক ধরনের ভয় কাজ করে। কারণ অনুসন্ধানে দেখা যায়, গ্রামের অনেকে জমি ভাগ চাষ করতে চায়। তাই কোনো ভাগচাষী মালিকের সাথে তর্ক করলে জমি হাতছাড়া হতে পারে। এজন্যও অনেকে চুক্তির কথা তোলে না।
বড়রামদেবপুরের এনায়েত বলেন, বর্গাচাষীরা এ এলাকায় এক সময় জমি মালিকদের প্রায় সমান তালে চলতে পারত। দেখা যেত একজন ভাগচাষী কয়েকবার একটি জমি চাষ করছে। কিন্তু বর্তমানে জমি মালিকরা বারবার জমি হাত বদল করছে। বিক্রি করছে। এজন্য ভাগচাষীরা আগামী বছর জমি পাবে কী না ? জমি এ মালিকের কাছে থাকে কীনা এ জাতীয় একটি ভয়ের মাঝে থাকছে।
ভাগচাষের ফলে চাষীরা মূলত ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। সদর উপজেলার সোন্দলপুর ও চাটখিল উপজেলার মোহাম্মদপুর গ্রামের কয়েকজন ভাগ চাষী জানান, গ্রামে বৌ-ছেলে নিয়ে থাকি। অন্য সময় বদলা দেই তাই ‘বাগা’ চাষ করি। কিন্তু এ চাষে লাভ নেই।
জমি মালিক ১০ গন্ডা জমি ভাগ চাষে দিলে তিনি কোনো খরচ দেন না। সমস্ত খরচ দিতে হয় ভাগচাষীকে। ১০ গন্ডা জমি হালচাষ ৫০০ টাকা, বীজ ৩০০ টাকা, ঘাস বাছাই ৪০০ টাকা, বীজ উৎপাদন ২০০ টাকা, সার, কীটনাশক ২৫০ টাকা, পানি সেচ ৮০০ টাকা, কাটাই মাড়াই ৩০০ টাকা। অর্থাৎ ১০ গন্ডা জমির পেছনে একজন ভাগচাষীকে প্রায় তিন হাজার টাকা খরচ করতে হয়। এছাড়াও ভাগচাষী ফসল লাগানো থেকে শুরু করে ফসল ঘরে তোলা নাগাদ প্রতিদিন গড়ে ৩/৪ ঘন্টা করে জমিতে কাজ করে। এ কাজের দাম কখনো হিসাব করা হয় না। কিন্তু ফসল উৎপাদন শেষে ফসল ভাগের সময় যে পদ্ধতিতেই ভাগ করা হোক না কেন ভাগ চাষীর এ শ্রমের অর্ধেক জমি মালিকের কাছে চলে যায়। কিন্তু ১০ গন্ডা জমিতে ধান পাওয়া যাবে ২০ মন। বাজার দর মনপ্রতি ২৫০ টাকা হারে হবে পাঁচ হাজার টাকা। ভাগচাষী পাবে ২৫০ টাকা। তাতে দৃশ্যত লাভক্ষতিতে ভাগচাষীর ৫০০ টাকা ক্ষতি হয়।
আবার জমি ব্যবহার করে ফসল উৎপাদন করছে বলে যে জমির দামও কমে যাচ্ছে তাও নয়। তথ্য সংগ্রহকালে দেখা যায়, প্রত্যেক এলাকায়ই যে জমির আগে প্রতি একরের দাম ছিল ৫০ হাজার এখন তা ৬০/৭০ হাজার টাকা হচ্ছে। ফলে জমি মালিককে সে দিকেও ঠকতে হয় না। এ প্রসঙ্গে শোলা গ্রামের বেলাল বলেন, এত হিসাব করার সময় কৈই? ধান যা পাই তা ভাগ করে দিয়ে দেই। জমি মালিক মাওলানা নুর ইসলাম বলেন, যে চাষ করবে সে তো শ্রম দিবেই এতে হিসাব অথবা ক্ষতির কি আছে।
তিনি আরো জানান, ভাগচাষের যে প্রথা তাতে চাষীরা উৎপাদনে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। দেখা যায়, ভাগচাষীদের পরিশ্রমে উৎপাদিত ফসলের বিরাট একটি অংশ মালিককে দিতে হয়। এতে ভাগচাষীরা উৎপাদনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।
ভাগচাষের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় জমির। বড়রামদেবপুরের অলি উল্যাহ বলেন, ভাগচাষের ফলে জমির মান কমে যায়। ভাগচাষী আগামী বছর জমি চাষ করতে পারবে কি পারবে না তার কোনো নিশ্চয়তা থাকে না। ফলে জমির কোনো উন্নয়ন করে না। অন্যদিকে ভাগচাষী মনে করে এ বছরই যা ফসল ফলানো যায় তাই লাভ, এ চিন্তা করে জমিতে বেহিসেবে সার কীটনাশক প্রয়োগ করে। ফলে জমির গুণগত মান কমে যায়।
No comments:
Post a Comment