Pages

Thursday, December 24, 2015

গ্রাম বাংলার কিছু চিরায়ত রুপ নিদর্শন

শ্বাসত গ্রাম বাংলার কিছু চিরায়ত বাঙ্গালিয়ানার নিদর্শন যা আমাদের প্রতিটি বাঙ্গালীর বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের শহর বা গ্রামঞ্চল ভেদে প্রতিটি নাগরিকের জানা বিশেষ প্রয়োজন।

ও ধান ভানিরে ঢেকিতে পাড় দিয়া- আমাদের ঢেকি শিল্প-
গ্রাম বাংলার বৌ ঝিদের সেই ধান চাল ভাঙ্গার ঢেকিতে পাড় দেওয়ার ছবি যেন ফুটে ওঠে এ গানটিতে।ঢেকি আমাদের এই বাংলার ইতিহাস ঐতিহ্যেরই একটি অংশ। আজকাল গ্রামের বাড়িগুলিতেও খুব কম পরিমান ঢেকিই চোখে পড়ে অথচ একদিন ঢেকি ছাড়া একটি বাড়িও কল্পনা করা কঠিন ছিলো। চাল ডাল মসলা ঢেকিতে ভানতো বাড়ির বৌ ঝিয়েরা। আজ ঢেকিতে ছাটা শস্যের বদলে এসেছে মিলে ছাটা চাল, ডাল মসলা। তাই আর আজকাল গ্রামের বাড়িগুলোতে ঢেকিতে পাড় দেবার ধুপধাপ শব্দও শোনা যায়না । শোনা যায়না সেই গান- ও ধান ভানিরে ঢেকিতে পাড় দিয়া, ঢেকি নাচে আমি নাচি হেলিয়া দুলিয়া। তবে ঢেকি ছাটা চালের কদর এখনও কমেনি কারন ঢেকি ছাটা চালের উপরের আবরন বা খোসা অন্নু থাকে যাতে প্রচুর পরিমান ভিটামিন রয়েছে। ঢেকি চালাতে সাধারনত দুজন লোকের প্রয়োজন হয়। এক্ষেত্রে সাধারনত মহিলারাই চালায় ঢেকি। একজন থাকেন বড় কাঠের সাথে লাগানো অংশ যার এক প্রান্ত উঠে যায় এবং যার পাশে হাত দিয়ে ধরার নির্দিষ্ট খুটি থাকে এটা পা দিয়ে চাপ দিতে আবার ছাড়তে হয়। অপরজন থাকেন নির্দিষ্ট গর্তে যেখানে আঘাতে চাল থেকে ধান বের হয় সেখানে সতর্কতার সাথে ধান দিতে হয় আবার প্রতি আঘাতের পর পর ধান নড়াচড়া করে উল্টে পাল্টে দিতে হয় যাতে সবগুলোতে আঘাত লাগে।

ইঁদারা বা পাতকুয়া-
বহু প্রাচীন বাড়িগুলিতে আজও দেখা পাওয়া যায় মজে যাওয়া কুয়া বা ইঁদারার। আজকালকার ছেলেমেয়েরা সেসব হয়তো টম এ্যান্ড জেরীর কার্টুনে জেরীকে কুয়া থেকে দড়ি দিয়ে টমের টেনে তুলবার দৃশ্য ছাড়া আর কোথাও দেখেইনা। প্রাচীনকালে মানুষ যখন ডোবা ও নদীর অপরিশুদ্ধ পানি পান করতো তখনকার বিজ্ঞানীরা অনেক গবেষণাকার্য সম্পন্ন করে কূপের জন্ম দেন। জমিদাররা ইঁদারাথেকে প্রাপ্ত পানিকে আরও পরিশুদ্ধ করতে ইঁদারার মধ্যে পাইপ লাগিয়ে পানি উত্তোলন করতো। এই কারনেই পুরানো জমিদার বাড়িতে বহু পুরোনো কুয়ার দেখা আজও মিলে। পর্যায়ক্রমে মানুষ যখন সভ্য, সুশিক্ষিত ও জ্ঞান বিজ্ঞানে সমৃদ্ধশালী হলো তখন নলকূপের সৃষ্টি হলো। সংস্কৃত ইন্দ্রাগার শব্দটি ইন্দ্র ও আগার থেকে এসেছে। ইন্দ্র অর্থ বৃহৎ এবং আগার অর্থ পাত্র অর্থাৎ ইন্দ্রাগার শব্দের অর্থ হলো বৃহৎ কূপ।

ও মাঝি নাও ছাইড়া দে, ও মাঝি পাল উড়াইয়া দে -পাল তোলা নাও বা পালের নৌকা-
পালের নৌকা বাংলার ঐতিহ্যের অন্যতম একটি নাম। শরৎকালে অমল ধবল পালে মৃদুমন্দ হাওয়ার খেলা দেখেই কবিগুরু লিখেছিলেন অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া। আগের দিনে ছোট বড় সবধরনের নৌকাতেই পাল ব্যবহার করা হত। মূলত মাঝিরা যখন দাড় টানতে টানতে ক্লান্ত হয়ে যেত বা বাতাস অনুকূল থাকলে পাল তুলে খুব তাড়াতাড়ি এক জায়গা হতে অন্য জায়গায় যাওয়া আসা করতো। তবে বর্তমানে প্রত্যেক নৌকায় পালের যায়গা দখল করেছে মেশিন।

পালকী চলে দুলকী তালে- পালকী
পালকি আগে অভিজাত শ্রেণীর চলাচলের জন্য বিশেষ করে মেয়েদের যাতায়তের জন্য ব্যবহার করা হত। তবে বর-কনের পরিবহণ করতে এই বিশেষ যানটির ব্যবহার উল্লেখ যোগ্য। বাঁশ, কাঠ, টিন ও লোহার শিক দিয়ে তৈরি পালকি খুব দৃষ্টিনন্দন ও শিল্প সমৃদ্ধ ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ছয়জন বেহারা পালকি বহন করত। সেকালে পালকি ছাড়া বিয়ের সুন্দর আয়োজনটা যেন অসম্পূর্ণ থেকে যেত। আজ যান্ত্রিক সভ্যতায় যন্ত্রের পরিবহণ ব্যবস্থার কাছে হারিয়ে গেছে পালকি।
ডুলি
বাঁশ ও পাটের দড়ি দিয়ে নির্মিত এক প্রকার ঝুলন্ত আরামদায়ক পরিবহণ। ডুলি দু জন বেহারা কাঁধে করে বহন করত। গ্রামের নববধূরা বাবার বাড়ি নায়র করতে যেতে বা বাবার বাড়ি হতে স্বামীবাড়ি যেত ডুলিতে চড়ে। বিয়ের দিন কনের সহযাত্রী বা আচল-দি হয়ে কনের নানী বা দাদী ডুলিতে চড়ে বরের বাড়ি আসতো। আজ আর নেই সেই বেহারা আর ডুলি। সব কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে।

আমার গরুর গাড়িতে বউ সাজিয়ে বা গাড়িয়াল ভাই এর সেই গরুগাড়ি
শুধু বউ নিয়ে যাবার জন্যই গরুর গাড়ির ব্যাবহার নয়। গ্রামবাংলার সবচাইতে প্রচলিত যানবাহন এই গরুর গাড়ি। গরুর গাড়ি বাঁশ ও কাঠ দ্বারা তৈরি হয়। গাড়িতে ছই আর মত ছাওনি দিয়ে একে সাজানো হয়।এছাড়া এককালে গ্রামের যে কোন পণ্য পরিবহণে ব্যবহার হত গরুর গাড়ি।

জসিমুদ্দিনের নকশী কাঁথার মাঠ বা বাংলার নকশিকাঁথা-
নকশীকাঁথা বাংলার ঐতিহ্য। পাখি, ফুল, লতা পাতা ও বিভিন্ন চিত্র একে মেয়েরা এককালে এক প্রকার আকর্ষণীয় কাঁথা তৈরি করতো। এতে ফুটে উঠতো গ্রাম বাংলার দৈনন্দিন জীবনের চিত্র। সুখ দুঃখ আনন্দ বেদনার গল্প। এই বিশেষ কাঁথাকে বলা হত নকশী কাঁথা। নকশীকাঁথা সেলাই করা একদিকে যেমন মেয়েদের শিল্প নৈপুণ্যের পরিচয় বহন করত, তেমনি অবসর কাটানোর একটি মাধ্যম এই নকশীকাঁথা। সে সময় এটি ছিল শীত নিবারণে গরীবদের অনন্য বন্ধু কিন্তু আজ এই নকশীকাঁথা ধনীদের বিলাস পণ্যে পরিণত হয়েছে। যদিও এটি পাওয়া খুব কঠিন তবে আড়ং বাংলার মেলায় উচ্চমূল্যে পাওয়া যায় নক্সিকাঁথা।

খেজুর পাতার পাটি -
এক সময় গ্রামবাংলার প্রতিটি ঘরে ব্যবহার করা হতো খেজুর পাতার পাটি । কিন্তু বর্তমানে আধুনিকতার ছেয়ায় তা আর কোন বাড়ীতে বলতে গেলে এই পাটি আর দেখাই যায়না। গ্রামের নিন্ম বিত্ত ও উচ্চ বিত্ত সব পরিবারের মহিলারা তাদের ঘরে শোবার জন্য বিশেষ করে গরমকালে ব্যাবহার করতো এই পাটি। এটি আর একটি গ্রামীণ ঐতিহ্যের অংশ। এ ছাড়া হাজার রকম কাজে এটি ব্যবহার করা হয়।

মাটির হাঁড়ি পাতিল-
এঁটেল মাটি দিয়ে তৈরী করা হয় মাটির হাড়ি পাতিল কড়াই। মাটি দিয়ে তৈরী শিল্পকে মৃৎশিল্প বলে। আর মৃৎশিল্পের কারিগরকে বলা হয় কুমোর। রান্না বান্না ও গৃহস্থালীকাজে ব্যাবহার হয় মাটির হাড়ি পাতিল তৈজসপত্র।
শখের হাড়ি- নক্সাদার সৌখিন হাড়ি বা নক্সীহাড়ি। এতে শখের জিনিষ তুলে রাখা হয় বা সাজানো হয়।

মাটির পুতুল বা টেপা পুতুল-
মাটি দিয়ে টিপে টিপে বানানো হয় বলেই এই পুতুলের নাম টেপা পুতুল। কিন্তু এই টেপা পুতুল বা মাটির পুতুল গ্রাম বাংলার চিরায়ত ঐতিহ্য। গ্রামের মেলায় বা হাঁটেও পাওয়া যেত এইসব পুতুল। আজকাল চারুকলায় বা বাংলা গ্রামীন ঐতিহ্যের দোকানগুলোতে দেখা মেলে এইসব টেপা পুতুলের।

কুড়েঘর- শনের ঘর বা মাটির ঘর-
আমরা সবাই গ্রামের ছবি এঁকেছি আর এই ছবি আঁকতে গেলে প্রথমেই যেই বিষয়টি অতি অবশ্য মাথাতে আসবেই সেটা একখানি কুড়েঘর আর তার পাশে গাছ পালা নদী। সে মাটি দিয়ে বা ছন দিয়ে ছাওয়া। আমাদের বাংলাদেশের এক অতি
পরিচিত ছবি যেন এই কুড়েঘর। কুড়ে ঘর ছাড়া বাংলাদেশের গ্রাম ও প্রকৃতি অসম্পূর্ণ।

লাঙ্গল জোয়াল
কালের বিবর্তনে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে আবহমান বাংলার কৃষি কাজে ব্যবহৃত লাঙ্গল, জোয়াল,মই। কৃষিপ্রধান আমাদের দেশে এক সময় খেতে-খামারে কৃষকের লাঙ্গল আর মই দিয়ে চাষাবাদের দৃশ্য সবার নজর কাড়তো। চাষাবাদের অন্যতম উপকরণ হিসেবে কাঠের লাঙ্গল ছিল অপরিহার্য। হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী চাষাবাদে বহুল ব্যবহৃত বাঁশ,কাঠের হাতল ও লোহার ফাল বিশিষ্ট কাঠের লাঙ্গল আজ বিলুপ্তির পথে। এক সময় কাঠের লাঙ্গল ছাড়া গ্রাম বাংলায় চাষাবাদের কথা চিন্তাই করা যেত না কিন্তু কালের বিবর্তনে বিজ্ঞানের যুগে পদার্পণ করে চাষাবাদের যান্ত্রিক সব সরঞ্জামাদি ক্রমশঃ হারিয়ে যাচ্ছে কৃষি কাজে ব্যবহৃত ওইসব লাঙ্গল, জোয়াল, মই ও হালের বলদ।

কুপি
যখন গ্রাম বাংলার গৃহে গৃহে ইলেক্ট্রিসিটি পৌছোয়নি তখন সন্ধ্যা বা সাঁঝের পর কুপির আলো ছাড়া আর কোনো পথ ছিলোনা। সেই অতি প্রয়োজনীয় কৃপি আজ বিলীন হওয়ার পথে।
একটা সময় ছিল যখন বাহারি ধরনের কুপিই ছিল মানুষের অন্ধকার নিবারণের একমাত্র অবলম্বন। কিন্তু কালের গহবরে কুপি বাতির স্থান দখল করে নিয়েছে বৈদ্যুতিক বাল্ব, চার্জার, হ্যারিকেনসহ আরো অনেক কিছুই। ফলে ক্রমে বিলীন হয়ে যাচ্ছে আবহমান গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যময় এই নিদর্শনটিও। কুপিগুলি ছিলো নানা ধরণের।কোনটি ছিল মাটির, কোনটি লোহার, কোনটি কাঁচের আবার কোনটি ছিল পিতলের তৈরী। 
তথ্যসূত্র: http://www.somewhereinblog.net/blog/Shyry/30030164

No comments:

Post a Comment